চট্টগ্রাম, বুধবার ৩১ মে, ২০২৩

Porisor banner

হার না মানা শিলা

পরিসর.কম

প্রকাশিত : ০৩:৫২ এএম, ২৯ মে ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ১০:৪৯ এএম, ২ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

হার না মানা শিলা

হার না মানা শিলা

‘দৌড়ের আইটেম শেষ। সাঁতারে নাম দিয়ে দিই, গোসল করে বাড়ি চলে যাস’- এমন একটি উক্তি থেকেই আমার সাঁতারু জীবনের শুরু।

কথাটি বলে সুন্দর হাসি ছড়িয়ে দিলেন শিলা। ফিরে গেলেন তাঁর প্রিয় শৈশবে। শোনালেন তাঁর সাঁতারু হয়ে ওঠার গল্প।

প্রিয় পাঠক, চলুন চোখ বুলিয়ে নেই আন্তর্জাতিক পরিসরে নারী সাঁতারে দেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণজয়ী মাহফুজা খাতুন শিলার সংগ্রাম ও সাফল্য গাঁথার পাতায়-পাতায়।

শিলা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি এ বিভাগের গর্ব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব, দেশের গর্ব।

শিলার সাঁতারু হয়ে ওঠার গল্প খানিকটা ভিন্ন, অদ্ভূতও বটে। বলা যায়, একটি ভুল থেকেই নিজের ভালোবাসার জগতে চলে এসেছিলেন তিনি। ভাগ্যই যেন তাঁকে টেনে নিয়ে এসেছে তাঁর আপনালয়ে। সাঁতারু হওয়ার আগে তিনি ছিলেন অ্যাথলেট। ছোটবেলা থেকেই দৌড়-ঝাঁপ করতেন আর স্কুলের মাঠে খেলাধুলা করে বেড়াতেন।

ছোট্ট শিলা তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। শিশু একাডেমির এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে বলে তার স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে রওনা হলো। কিন্তু খেলার মাঠে পৌঁছে জানা গেলো দৌড়ের ইভেন্ট শেষ। তখন বাকি ছিল কেবল সাঁতার। শিলার মন খারাপ। স্যার বললেন, ‘সাঁতারে নাম দিয়ে দিই। হার-জিতের বিষয় নেই। গোসল করে বাড়ি চলে যাস।’

ডানপিটে শিলা খুশি মনে স্যারের কথায় রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু বাঁধ সাধে শিশু একাডেমির লোকজন। কেননা বাচ্চা বলে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চাননা। তিন তিনবার পানি থেকে তুলে দেওয়ার পরও নাছোড়বান্দা শিলার জেদ আর তাঁর সেই শিক্ষকের বহু আকুতি-মিনতির পর অংশ নেওয়ার সুযোগ মিললো।

সেদিন কিন্তু নিছক গা ভিজিয়ে শিলাকে বাড়ি ফিরতে হয়নি, চিতসাঁতারে প্রথম হওয়ার গৌরব নিয়ে সে বাড়ি ফেরে। সাঁতারে এটিই শিলার প্রথম সাফল্য। এখান থেকেই সাতারু শিলার যাত্রা শুরু। এরপর কতকিছু। কত প্রতিযোগিতা, প্র্যাকটিস, ফেডারেশনের নিয়ম নীতি। তবে কাক্সিক্ষত সফলতা পেতে শিলাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ এক বন্ধুর পথ। সাঁতার ফেডারেশনের অবহেলা, বঞ্চনা, দরিদ্রতা- এমন নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তবেই তিনি আজকের স্বর্ণজয়ী শিলা।

স্বর্ণজয়ী মাহফুজা খাতুন শিলা

‘আমি সাঁতার নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পরে গিয়েছিলাম’- তিনবছর আগে সাঁতার ফেডারেশনের কতিপয় লোকের অসহযোগিতা আর বঞ্চনায় মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি, সে কথা জানাতেই এই উক্তি শিলার।

জানালেন, একটি তুচ্ছ নিয়মের কথা বলে তাঁকে অলিম্পিক গেমস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। দেশে যাদের টাইমিং ভালো তাদেরই আন্তর্জাতিক বিটে পাঠানোর কথা থাকলেও তাঁর বেলায় ঘটেছে অন্যরকম। গোপালগঞ্জ জাতীয় সাঁতারে ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে এসএ গেমসে টাইমিং ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও ওয়ার্ল্ড সুইমিংয়ে তাঁকে পাঠানো হয়নি, মনোনীত করা হয়নি অলিম্পিক গেমসের জন্যও। এক্ষেত্রে সিলেকশন কমিটির একটি হাস্যকর যুক্তি ছিল, জাতীয় সাঁতারে যে বেশি স্বর্ণ জিতেছে সেই যাবে অলিম্পিকে! শিলা বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি যতই ভাল করুন না কেনো নানা ছুতোয় তাকে শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই হতে হবে। রাগে-ক্ষোভে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু নৌবাহিনীর হয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিবেন এবং পড়াশুনা চালিয়ে যাবেন। তাই তিনি এসএ গেমসের ক্যাম্পেও আর যোগ দেননি।

গেমসের তিন মাস আগে শিলার জীবনে আবারও আবির্ভাব ঘটে একজন ত্রাণকর্তার, ঠিক ছেলেবেলার সেই শিক্ষকের মতন। এবার সেই ত্রাতা হলেন কোরিয়ান কোচ পার্ক তে গুন। তিনি ঢাকায় আসার পর শিলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং অনুরোধ করেন এসএ গেমসের ক্যাম্পে যেনো যোগ দেন। শিলাকে নিয়ে পদক জয়ের চেষ্টা করতে চান। সেদিন শিলা তাঁর কোচের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। তিনি ক্যাম্পে ফিরে গেছেন এবং কোচকে দিয়েছেন তাঁর আশানুরূপ উপহার, আর তা হলো সাঁতারে স্বর্ণজয়ের কৃতিত্ব। তবে জয়ের পথে শিলার এগিয়ে যাওয়ার এই গল্পটা সহজ ছিলনা মোটেও। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে মাত্র মাইক্রো সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি স্বর্ণ জিততে পারেননি, দুটি রৌপ্য অর্জন করেছিলেন। তারও আগে এই একই ইভেন্টে ২০০৬ সালে তিনি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন।

অবশেষে ২০১৬ সালে ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত ১২তম এসএ গেমসে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে জোড়া স্বর্ণজয় করে লাল-সবুজের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন তিনি। একইসাথে এটিও প্রতিষ্ঠিত করেন যে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যেকোন অজেয়কে জয় করা সম্ভব।

সাঁতারের পথে শিলার আগমন ও সাফল্য- এ দুয়ের মাঝেও রয়েছে আরেকটি গল্প।

সময়টা ২০০২ সাল, বাংলাদেশ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে শিলা তৃতীয় হলেন। এরপর বিকেএসপির সোলেমান স্যার তাঁকে  সেখানে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু অসচ্ছল পরিবারের মেয়ের বিকেএসপিতে লেখাপড়ার খরচ যোগাবে কে? এগিয়ে এলেন এলাকার সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বিশ্বাস, স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ অনেকেই। তাঁদের সাহায্য ও সহযোগিতায় ২০০২ সালের শেষের দিকে তিনি বিকেএসপিতে ভর্তি হন। সেখানে ব্রেকস্ট্রোক সাঁতারু হয়ে খেলা শুরু করলেও পরবর্তীতে ২০০৩ সালে জাং ফাং নামের চীনা কোচের মাধ্যমে ব্রেস্টস্ট্রোকে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। ওই বছরই জাতীয় সাঁতারে ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে সোনা জিতেছিলেন, তবে ১০০ মিটারে পারেন নি। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে দুটো ইভেন্টেই তাঁর সোনা  জেতা শুরু এবং এখনো পর্যন্ত এ জয় তাঁরই দখলে। শিলার এই ধারাবাহিক জয়ের পেছনে কেবল তাঁর সাঁতারে আসার সাতকাহন নয়, লুকিয়ে আছে অনেক অজানা রহস্যও। সে সম্পর্কে বললেন শিলার কোচ পার্ক তে গুন, ‘শিলা অত্যন্ত পরিশ্রমী, উদ্যোমী ও একনিষ্ঠ একজন খেলোয়াড়। একমাত্র কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে  সে এসএ গেমসের স্বর্ণ জিতেছে। শিলার পায়ের জয়েন্টে কিছু ইনজুরি আছে। যা সারিয়ে তুলতে ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজন অনুযায়ী সচরাচর ফিজিওথেরাপিস্ট পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় দেখা যায় শিলা নিজেই তাঁর পায়ের পরিচর্যা করছে এবং ইনজুরির পরোয়া না করে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে।’

সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শিলা তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন। কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নামকরা সব পুরস্কার। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির বিচারে ২০১৬ সালের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন বাড়ি। সম্প্রতি ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সঙ্গে যুগ্মভাবে পেয়েছেন প্রথম আলোর বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ পুরস্কার। নিজের স্বপ্ন পূরণে কতোটা স্বার্থক হয়েছেন জানতে চাইলে শিলা জানান, ‘তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে। এখন তিনি যা দেখছেন তা হলো, “স্বপ্নের পরের স্বপ্ন”। কারণ মানুষের স্বপ্নের শেষ  নেই।’ এখন অলিম্পিকের স্বপ্ন তাঁর দুই চোখে।

তবে শিলার লক্ষ্য জাতীয় দলের কোচ হওয়া এবং নিজহাতে তাঁর চেয়ে দক্ষ ও একনিষ্ঠ খেলোয়ার গড়ে তোলা। হার-জিতের পরোয়া না করে কেবল খেলাধুলাকে ভালোবেসে অকস্মাৎ পানিতে নেমে পড়া সেদিনকার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত মাড়িয়ে ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়, দেশকে এনে দিয়েছেন এক নব গৌরবগাঁথা। অদূর ভবিষ্যতে খেলা-পাগল এই মেয়েটিই হয়ত হবেন তাঁর মত হাজারো শিলা গড়ে তোলার কারিগর।

প্রতিবেদন গ্রুপ: ময়মী আক্তার, মো. জুয়েল মিয়া, শামসুল ইসলাম, সাদিয়া বিনতে শাহজাহান ও ইরফান উদ্দিন।